বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা ইত্যাদি নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে লেগেই আছে। এসব দুৰ্যোগে জানমালের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বড় অন্তরায়। পরিবেশের ওপর মানুষের নানারকম হস্তক্ষেপের ফলে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাম্প্রতিক কালে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা :
৯.১.১ বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
তোমরা ইতোমধ্যে আবহাওয়া, জলবায়ু এবং তাদের পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে জেনেছ। এখন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল আর তার প্রভাব সম্পর্কে জেনে নিই।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এর মাঝেই লক্ষণীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। নিচে এগুলো তুলে ধরা হলো।
ঋতুর পরিবর্তন
বাংলাদেশ হয় ঋতুর দেশ এবং একসময় প্রতিটি ঋতুর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এ ঋতুচক্রের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হতে দেখা যাচ্ছে। আষাঢ় ও শ্রাবণ, দুই মাস বর্ষাকাল হলেও দেখা যাচ্ছে যে আশ্বিন মাসেও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে, শুধু তা-ই নয়, তা অসময়ে বন্যার কারণ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে শীতকাল ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এটিও লক্ষণীয় যে গ্রীষ্মকালে অনেক বেশি গরম পড়ছে এবং মাঝে মাঝে দেশের কোনো কোনো এলাকায় দিনের তাপমাত্রা ৪৫-৪৮° সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। অন্যদিকে শীতের সময় কখনো কখনো তাপমাত্রা অনেক বেশি কমে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক এই গরম আর শীতের কারণে কোথাও কোথাও প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটছে।
বন্যা
নদীমাতৃক বাংলাদেশে বন্যা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার এবং অনেকাংশেই দরকারি। বন্যার ফলে জমিতে পলি পড়ে, যা জমির উর্বরতা বাড়ায়, এতে ফসল উৎপাদন ভালো হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে জলবায়ুজনি পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন এবং অসময়ে প্রলংয়করী বন্যা লক্ষ করা যাচ্ছে। আগের দিনে এ ধরনের বন্যা যে হয়নি তা নয়, তবে এত ঘন ঘন হয়নি। ১৯৮৮, ১৯৯৫, ১৯৯৮, ২০০৫ সালে বাংলাদেশে প্রসংয়করী বন্যায় জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।এ কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশের যে সকল অঞ্চল বন্যাপ্রবণ নয়, যেমন: যশোর, ঢাকা সে সকল অঞ্চলও মাঝে মাঝে এখন বন্যায় প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে।
নদীভাঙন
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীভাঙন একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও সাম্প্রতিককালে তা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এতে একদিকে যেমন বিপুল জনগোষ্ঠী ঘর-বাড়ি হারিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে আবাদি জমিও নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিশাল জনসংখ্যার দেশটির জন্য এটি মারাত্মক একটি সমস্যা। নদীভাঙনের ফলে গৃহহারা লোকজন যাযাবরের মতো বা শহর অঞ্চলের বস্তিতে অমানবিক জীবনযাপন করছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিগত তিন দশকে প্রায় ১৮০,০০০ হেক্টর জমি শুধু পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা এই তিন নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে।
খরা
কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় খরা বাংলাদেশের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, যা বৃষ্টিপাতের উপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলছে। কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টিপাত একেবারেই কমে গিয়ে খরার সৃষ্টি করছে। জলবায়ুজনিত সৃষ্ট খরায় বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
পানির লবণাক্ততা
জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি মূল ভূখণ্ডে ঢুকে নদ- নদী, ভূগর্ভের পানি এবং আবাদি জমিও লবণাক্ত হয়ে পড়বে। তখন একদিকে যেমন খাওয়ার পানির প্রচণ্ড অভাব দেখা যাবে, অন্যদিকে তেমনি জমিতে লবণাক্ততার জন্য ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হবে। অতি সাম্প্রতিককালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৮৩০,০০০ হেক্টর জমি লবণাক্ততার কারণে কৃষি অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কাজেই জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত পানির কারণে বাংলাদেশে ভয়াবহ খাদ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হয় তাহলে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে ২১০০ সালের মধ্যে ৩০% খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ চাল আর গমের উৎপাদন যথাক্রমে ৮.৮% এবং ৩২% হ্রাস পাবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলীয় বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার প্রায় ১৩% কৃষিজমি এর মাঝেই লবণাক্ততার শিকার হয়ে গেছে। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ১৬% এবং ২১০০ সাল নাগাদ সেটি ১৮% এ পৌঁছাবে।
সামুদ্রিক প্রবাল ঝুঁকি
সামুদ্রিক প্রবাল তাপমাত্রার প্রতি খুব সংবেদনশীল। সাধারণত ২২-২৮° সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রবালের জীবনযাপনের জন্য উপযোগী। এই তাপমাত্রার ১-২° বেড়ে গেলেই তা প্রবালের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে কাজ করে। এক গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যে পরিমাণ প্রবাল ছিল, ২০১০ সালে তার প্রায় ৭০% বিলীন হয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এক্ষেত্রে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি ছাড়াও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা না থাকাও এর অন্যতম কারণ
বনাঞ্চল
বাংলাদেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন হলো সুন্দরবন, যা শুধু যে জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ এক বন তা নয়, এটি আমাদের মহামূল্যবান সম্পদ। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এছাড়া এই অঞ্চলে সাইক্লোন, হ্যারিকেন প্রতিরোধে এই সুন্দরবন রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। সাম্প্রতিককালের ঝড়ে এর বড় একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে সমুদ্রের পানির উচ্চতা যদি ৪৫ সেন্টিমিটার বাড়ে, তাহলে আমাদের একমাত্র এই ম্যানগ্রোভ বনের ৭৫% পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আর যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়ে, তাহলে প্রায় পুরো সুন্দরবন এবং এর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
মৎস্যসম্পদ
এক সময় বাংলাদেশের নদ-নদী, পুকুর কিংবা বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনেক নদীতে এখন আর আগের মতো পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মাছের বাসস্থান, খাদ্য সংগ্রহ এবং জৈবিক নানা প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে, এমনকি মাঝে মাঝে মাছ মারাও যায়। অনেক মাছ এবং মাছের পোনা পানির তাপমাত্রা ৩২° সেলসিয়াসের বেশি হলে মরে যায়। যেহেতু উচ্চ তাপমাত্রা (৩৫° সেলসিয়াস) রোগজীবাণু জন্মাতে সাহায্য করে, তাই তাপমাত্রা বেড়ে গেলে মাছে রোগ সংক্রমণ বেশি হয় এবং মাছের মড়ক লাগে। এছাড়া লবণাক্ত পানি মূল ভুখণ্ডের মিঠা পানিতে ঢুকে পড়লে মিঠা পানির মাছও আর বাঁচতে পারবে না ।
স্বাস্থ্যঝুঁকি
জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন প্রলয়ংকরী বন্যায় মারাত্মক পানিদূষণ হয় এবং পানিবাহিত নানা ধরনের রোগ, বিশেষ করে কলেরা ও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে। অসময়ে বন্যা-খরার কারণে ফসলের ক্ষতি হয়, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়, যা খাদ্যঘাটতি সৃষ্টি করে। পানির মতো বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বাড়লে রোগজীবাণু বেশি জন্মাবে এবং নানারকম রোগ সংক্রমণ বেড়ে যাবে। আগে আমরা বাংলাদেশে কখনো অ্যানথ্রাক্স রোগের কথা শুনিনি। কিন্তু গত ৩-৪ বছর যাবৎ বর্ষার মৌসুমে বাংলাদেশে, বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ জেলায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে গবাদিপশু ও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এ এলাকার পশু চিকিৎসক ও খামারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ উপযুক্ত চিকিৎসায় ভালো হয়ে গেলেও গবাদিপশুর জন্য মৃত্যু অবধারিত। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে অ্যানথ্রাক্সের মতো আরো অনেক প্রাণঘাতী রোগ-জীবাণু সৃষ্টি হতে পারে।
জীববৈচিত্র্য
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক উদ্যোগে নেওয়া না হলে জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ৩০% জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
সাইক্লোন
সাইক্লোনের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরো ঘন ঘন এবং অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক আকার ধারণ করবে। এ বিষয়ে এই অধ্যায়েই তোমরা আরো বিস্তারিত জানবে।
জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্রভাব মূল্যায়নের জন্য গঠিত Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)-এর চতুর্থ মূল্যায়ন রিপোর্ট (AR4) অনুযায়ী, জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের প্রভাব অনেক মারাত্মক এবং তা ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা গত ১০০ বছরে প্রায় ০.৭° সেলসিয়াস বেড়েছে। ১৯৬১-২০০৩ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা গড়ে প্রতিবছরে ১.৮ সেন্টিমিটার করে বেড়েছে। ইতোমধ্যেই পাহাড় পর্বতে জমে থাকা বরফের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। ১৯৯৫-২০০৬ পর্যন্ত ১২ বছরের মধ্যে ১১ বছরই প্রচণ্ড গরম পড়েছে। ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী দুই দশকে বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা প্রতি দশ বছরে গড়ে ০.২-০.৩° সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাবে। অনুমান করা হচ্ছে, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.১-৬.৪° সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। তখন নাতিশীতোষ্ণ ও বিষুবরেখা থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে পানির প্রাপ্যতা বেড়ে যাবে কিন্তু বিষুবরেখার নিকটবর্তী ও মাঝামাঝি স্থানে পানির প্রাপ্যতা কমে যাবে। অর্থাৎ কোনো কোনো অঞ্চলে প্রলংকরী বন্যার আশঙ্কা বেড়ে যাবে, আর কোনো কোনো অঞ্চল ভয়াবহ খরার কবলে পড়বে। ২০৮০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। সত্যি যদি তা-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের বেশির ভাগ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। তোমরা কি জান, মালদ্বীপ ও ভারতের কিছু অংশ ইতিমধ্যেই পানিতে ডুবে গেছে? বিগত কয়েক বছরে সাইক্লোন, টাইফুন, হ্যারিকেন এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক বেড়েছে, ভবিষ্যতে তা আরো প্রকট হওয়ার আশংকা আছে। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, আইলা, সিডর, নার্গিস, ক্যাটরিনার কথা আমরা সবাই জানি। এ ধরনের ভয়াবহ দুর্যোগ আরো ঘন ঘন হবে এবং তার মাত্রা আরো ভয়ানক হতে পারে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি স্থান এখন নানা রকম পরিবেশগত সমস্যায় জর্জরিত। তোমরা কি এরকম সমস্যাগুলো অনুধাবন করতে পারছ? নানা রকম পরিবেশগত সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি (Population Growth)। এটি একদিকে যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আবার অনেক পরিবেশগত সমস্যার মূল কারণও এটি। তোমরা কি জান, বর্তমানে সারা বিশ্বে জনসংখ্যা কত? প্ৰায় সাত বিলিয়ন। বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে করে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১০ বিলিয়ন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৫০ সালের পর থেকে শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে। সাথে সাথে হাজার হাজার বনজ গাছপালা এবং জীবজন্তুর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খোদ বাংলাদেশেই হাজার হাজার একর আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। এটিই স্বাভাবিক, কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি সব রকমের চাহিদা বেড়ে যায় এবং কর্মসংস্থানের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। কর্মসংস্থানের চাপ সামলানোর জন্য নতুন নতুন শিল্প-কারখানা তৈরি করতে গিয়ে আবাদি জমি এবং বনভূমি পর্যন্ত উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যার জন্য চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় আজ নদ-নদীতে মাছের যেন রীতিমত আকাল পড়ে গেছে। বাংলাদেশ মাছ চাষে পৃথিবীর চতুর্থতম দেশ এবং “মাছে ভাতে বাঙালি” এই কথাটি ধরে রাখার জন্যে প্রাকৃতিক মাছের উপর ভরসা না করে এখন চাষ করা মাছের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট খাদ্যশস্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৯.৩২ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা ২০০৭-২০০৮ সালে দাঁড়ায় প্রায় ৩০ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং ২০১০-১১ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। প্রায় ২০ বছর সময়ের ব্যবধানে খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে বাংলাদেশ আজ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে।
কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাঝে মাঝেই ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। তোমরা কি জান, ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা কত ছিল? বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ কোটির মতো, যেটি এখন প্রায় ১৬ কোটি। আমাদের এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি কম হতো তাহলে আজ বাংলাদেশে খাদ্যশস্য অনেক বেশি উদ্বৃত্ত থাকত, সেগুলো রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা যেত যা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা যেত। কাজেই জনসংখ্যার এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে এবং অন্যদেরকেও সচেতন করতে হবে।এখন প্রশ্ন হলো, জনসংখ্যা কেন এভাবে বৃদ্ধি পায়? তোমরা জান যে একটি এলাকায় একদিকে যেমন শিশুর জন্ম হয়, অন্যদিকে তেমনি নানা বয়সের লোক মৃত্যুবরণ করে। কোনো এলাকায় শিশু জন্মহার এবং মৃত্যুহার সমান হলে ঐ এলাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না। কিন্তু একটি এলাকায় যে কয়জন লোক মৃত্যুবরণ করে, তার চেয়ে শিশুর জন্মের সংখ্যা যদি বেশি হয়, তা হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া না পাওয়া অবশ্য আরো দুটি অবস্থার ওপর নির্ভর করে আর সে দুটি হলো বহির্গমন এবং বহিরাগমন। বহির্গমনের ফলে একটি দেশের জনসংখ্যা কমে যায় আর বহিরাগমন বা বাইরে থেকে আগমনের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হলো এখানে জন্মহার মৃত্যুহারের চেয়ে অনেক বেশি।
আরেকটি পরিবেশগত পুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো নগরায়ণ (Urbanization)। এটিও আসলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সম্পৃক্ত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কর্মসংস্থানের জন্য গ্রামীণ জনসংখ্যার বড় একটি অংশ শহরমুখী হয়ে পড়েছে। একই সাথে শহরাঞ্চলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যে খুব একটা কম তাও নয়। গ্রামীণ জনপদের শহরমুখিতা এবং শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য শহর এলাকায় আবাসন-সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে এবং এর ফলে আশপাশের আবাদি জমি ধ্বংস করে বা জলাভূমি ভরাট করে নগরায়ণ করা হচ্ছে। নতুন নগরায়ণের বেলায় প্রায় সময়েই ভালো বর্ণ ব্যবস্থাপনা, পানি সরবরাহসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা না থাকায় জীবনযাপনে নানারকম সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
এর আগের শ্রেণিতে তোমরা বৈশ্বিক উষ্ণতা কী তা জেনেছ। এর মূল কারণ হলো কার্বন ডাই- অক্সাইডসহ ওজোন, মিথেন, সিএফসি, নাইট্রাস অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্প, যেগুলো গ্রিন হাউস গ্যাস নামে পরিচিত, সেগুলোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। গ্রিন হাউস গ্যাসগুলো বাড়ার কারণ কী? এই গ্যাসগুলোর মূল উৎস হলো যানবাহন, শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া,রেফ্রিজারেটর কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে ব্যবহৃত প্যাস। এছাড়া কিছু কিছু প্রাকৃতিক কারণ (যেমন : আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, দাবানল, গবাদিপশুর মলমূত্র, প্রাকৃতিকভাবে গাছপালার ক্ষয়) ইত্যাদি দায়ী । জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যানবাহন, শিল্প-কারখানা, বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে, ফলে গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণও বেড়ে যাচ্ছে। আবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে প্রাকৃতিক উপায়ে গাছপালার যারা কার্বন ডাই-অক্সাইডের শোষণ কমে যাচ্ছে, যার ফলে বায়ুমণ্ডলে এর পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণ এই গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ না কমালে, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বেড়ে যাবে (চিত্র ৯.০২) যার ফলে জলবায়ুজনিত পরিবর্তন ঘটবে। জলবায়ুজনিত পরিবর্তন ঘটলে পরিবেশে কী ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে, সেটি তোমরা এই অধ্যায়ের শুরুতেই জেনেছ।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকেই কার্বন দূষণ বলে। বাতাসে কার্বন ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ কেন বেড়ে যায় সেটা তোমরা আগের পাঠে জেনেছ।
বনশূন্য করা একটি মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা। তোমরা ইতোমধ্যেই জেনেছ যে বনশূন্য করা বা বনভূমির উজাড় হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে জনংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, অন্ন, বস্ত্র ইত্যাদি সব রকম চাহিদা বৃদ্ধি পায়। আর প্রতিটি চাহিদাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বনশূন্য করার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
৯.৩.১ বন্যা
নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্য বন্যা (চিত্র ৯.০৩) একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিবছরই বন্যায় দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে ফসল, গবাদিপশু এবং অন্যান্য সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হয়, যা মাঝে মাঝে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৫, ২০০৪ এবং ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ১৯৭৪ সালে এই ক্ষতির মাত্রা এত বেশি ছিল যে সেটি বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।এখন প্রশ্ন হলো কেন বন্যা হয়, এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ কী? বন্যা হওয়ার পিছনে বেশ কিছু জটিল কারণ আছে। যার মাঝে অন্যতম কারণটি হচ্ছে নদ-নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়া। নদীভাঙন, বর্জ্য অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদ-নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। যে কারণে ভারী বর্ষণ বা উজানের অববাহিকা থেকে আসা পানি খুব সহজে সাগরে যেতে পারে না এবং নদী ভরে দুকূল ছাপিয়ে বন্যা সৃষ্টি করে।
এছাড়া মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট জোয়ারের কারণে উজানের পানি অনেক সময় নদ-নদীর মাধ্যমে সাগরে যেতে পারে না। ফলে নদ-নদীর আশপাশের এলাকায় বন্যা সৃষ্টি হয়। আবার বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকা সমতল হওয়ায় বৃষ্টির পানি সহজে নদ-নদীতে গিয়ে পড়তে পারে না। কাজেই বিস্তীর্ণ এলাকা, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। সাম্প্রতিক কালে ঘূর্ণিঝড় আইলা ও সিডর এবং এদের প্রভাবে সৃষ্ট বন্যার কথা আমরা সবাই জানি।এখন আমরা এই বন্যা প্রতিরোধ, মোকাবিলার কৌশল, করণীয় ও উপায় সম্পর্কে জেনে নেই। যেহেতু বন্যা সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ হলো নদ-নদীসমূহের সীমিত পানি ধারণক্ষমতা। তাই বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে নদী খনন করে এদের পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে যেন, ভারী বর্ষণ বা উজানের পানি এলেও বন্যা না হয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ১৯৬০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে প্রায় প্রতিবছরই অনেক জায়গায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙনের ফলে (বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ জেলায়) বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। অনেক সময়েই এটি ঘটে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিংবা ব্যক্তিদের অদক্ষতা বা অব্যবস্থাপনার কারণে।
নদী শাসন করেও বন্যা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া যায়। নদী শাসন হচ্ছে, নদীর পাড়ে পাঘর, সিমেন্টের ব্লক, বালির বস্তা, কাঠ বা বাঁশের ঢিবি তৈরি করে এগুলোর মাধ্যমে বন্যা প্রতিরোধ করা। এছাড়া নদীর পাড়ে গাছ লাগানো, পানিপ্রবাহের জন্য ফ্লুইস গেট নির্মাণ— এগুলোও নদী শাসনেরই ।
বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কবাণী
বন্যা সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাস এবং সতর্কবাণী প্রচার করে বন্যাজনিত ক্ষতির পরিমাণ অনেকখানিই কমানো যেতে পারে। বাংলাদেশের ৫৮টি নদীর উৎপত্তিস্থল হচ্ছে ভারত, নেপাল ও ভুটান। তাই সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া অনেক সময়েই সম্ভব হয় না। কাজেই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে, যেন আগে থেকেই এ সংক্রান্ত সব তথ্য পাওয়া যায় এবং তার উপর ভিত্তি করে একটা ফলপ্রসূ ব্যবস্থা নেওয়া যায় ।এছাড়া নিচু এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায় যেন জনবসতি গড়ে উঠতে না পারে, সেজন্য ভূমি ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং করণীয় সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা বন্যা মোকাবেলায় অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। তাই এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভয়াবহ বন্যা হলে সরকারি উঁচু ভবন কিংবা স্থাপনা যেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সাময়িক আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করতে পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আবার উঁচু স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র বা মালামাল সংরক্ষণ কেন্দ্র, উঁচু রাস্তাঘাট, উঁচু স্থানে বাজার কিংবা স্কুল ইত্যাদি তৈরি করে বন্যা মোকাবেলা করা যায়। বন্যার সময় বেশির ভাগ রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যায়। তখন চলাচলের জন্য স্পিডবোট এবং নৌকার ব্যবস্থা রাখাও বন্যা মোকাবেলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে ।বন্যার আগাম প্রস্তুতিও বন্যা মোকাবিলার একটি কৌশল হিসেবে গণ্য করা হয়। বিপুল জনসংখ্যা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়লে এবং আগে থেকে পর্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্য, পানি, ঔষধপত্র ইত্যাদির ব্যবস্থা করে না রাখলে তা ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। কোনো একটি এলাকা বন্যাকবলিত হলে তখন সেখানকার মানুষের কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা থাকে না। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য জীবন যাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তাদের পুনর্বাসনের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখতে হবে।
খরা একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খরার সমর মাটিতে পানির পরিমাপ কমতে কমতে মাটি পানিশূন্য হয়ে যায় এবং এর ফলে মাটিতে গাছপালা বা শস্য জন্মাতে পারে না। ব্রিটিশরা একটানা দুই সপ্তাহ ০.২৫ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাত হলে তাকে খরা (Absolute Drought) আর একটানা ৪ সপ্তাহ ০.২৫ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত না হলে তাকে আংশিক খরা (Partial Drought) বলে। রাশিয়াতে একটানা ১০ দিন মোট ৫ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি না হলে তাকে খরা বলে আর আমেরিকাতে একটানা ৩০ দিন বা তার বেশি সময়ের মধ্যে যেকোনো ২৪ ঘণ্টায় ৬.২৪ মিলিমিটার বৃষ্টি না হলে তারা ঐ অবস্থাকে খরা হিসেবে ধরে নেয়। খরা একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ (চিত্র ৯.০৪)। খরা হলে ফসল উৎপাদন কমে যায় এবং এটি দুর্ভিক্ষের কারণও হতে পারে। খরার ফলে শুধু মানুষ নয়, গবাদিপশুর জন্যও খাদ্যসংকট দেখা দেয়। কৃষিনির্ভর শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়, যেটি কর্মসংস্থানের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। খরার কারণে মাটির উর্বরতা কমে যায়। দীর্ঘস্থায়ী খরার কারণে দেশে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা (রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর) খরার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশে ১৯৭৮-৭৯ সালে ভয়াবহ খরা হয়েছিল। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই খরায় ক্ষতির পরিমাণ ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যার চেয়েও বেশি ছিল।
কেন খরা হয়? খরা হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে, যার মাঝে অন্যতম হচ্ছে দীর্ঘদিন শুষ্ক আবহাওয়া থাকা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হওয়া। বাষ্পীভবন এবং প্রস্বেদনের পরিমাণ বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি হলেও এমনটি ঘটতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বৃক্ষনিধন এবং গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাবে বায়ুমণ্ডল ধীরে ধীরে রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে উঠেছে, ফলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, যেটি খরা সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত কমে খরা সৃষ্টি হওয়ার জন্য পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের মেরু অঞ্চলে সৃষ্ট এল-নিনো (El-Nino) নামে জলবায়ুর পরিবর্তনচক্রকে দায়ী করা হচ্ছে। খরার জন্য দায়ী একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে গভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভের পানির মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাওয়া। এছাড়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন, উজান থেকে পানি সরিয়ে নেওয়া, পানি সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার অভাব, ওজোন স্তরের ক্ষয়— এগুলোও খরা সৃষ্টির জন্য দায়ী।
এখন প্রশ্ন হলো, খরা প্রতিরোধে বা খরা মোকাবিলার জন্য কী করা যেতে পারে? যেহেতু খরার মূল কারণ হলো পানির অপর্যাপ্ততা, তাই পানির সরবরাহ বাড়ানোই হচ্ছে খরা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। বাংলাদেশের প্রায় ৫৫টি নদীর উৎসস্থল ভারত। শুষ্ক মৌসুমে ভারতের ঐ সকল নদ- নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তন এবং পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশে খরার অন্যতম কারণ। এর আগে গঙ্গা নদীর পানিও ভারত একতরফাভাবে ব্যবহার করত। ১৯৯৬ সালে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে পানি বণ্টন চুক্তির কারণে বাংলাদেশ এখন শুষ্ক মৌসুমে পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে। গঙ্গার পানির চুক্তির মতো তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পানি বণ্টনের জন্য ভারতের সাথে পানি বণ্টন চুক্তি করার চেষ্টা চলছে, যেন শুষ্ক মৌসুমে ভারত একতরফাভাবে উজান থেকে পানি সরিয়ে নিতে না পারে ।
কিছু ফসল আছে যেগুলো মাটিতে পানি কম থাকলেও জন্মাতে পারে। যেমন: গম, পিঁয়াজ, কাউন ইত্যাদি। খরা পীড়িত এলাকার মানুষকে এ জাতীয় ফসল চাষ করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। সেই সাথে সাথে যে সমস্ত ফসল উৎপাদনে অনেক বেশি পানির প্রয়োজন হয়, যেমন: ইরি ধান, সেগুলো ষে খরাপীড়িত এলাকার মানুষদের নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে। খরা মোকাবেলা করার জন্য পুকুর, নদ-নদী, খাল-বিল খনন করে পানি ধরে রেখে তা খরার সময় ব্যবহার করার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি সৃষ্টি করে কিছু কিছু দেশ খরা মোকাবেলার চেষ্টা করেছে কিন্তু সেটি খুব একটা কার্যকর হয়নি।
সাইক্লোন শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ "Kyklos" থেকে, যার অর্থ হলো Coil of Snakes বা সাপের কুণ্ডলী। সাইক্লোনের স্যাটেলাইট ছবি থেকে দেখা যায়, প্রচণ্ড গতিবেগসম্পন্ন বাতাস কুণ্ডলীয় আকারে ঘুরপাক খাচ্ছে (চিত্র ১.০৫)। অর্থাৎ নিম্নচাপের কারণে যখন বাতাস প্রচণ্ড গতিবেগে ঘুরতে থাকে, তখন সেটাকে সাইক্লোন বা ঘুর্ণিঝড় বলে। দক্ষিণ এশিয়াতে আমরা যেটাকে সাইক্লোন বলি, আমেরিকাতে সেটাকে হ্যারিকেন (Hurricane) এবং দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতে টাইফুন (Typhoon) বলে।
বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বত, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং মাঝখানে ফানেল আকৃতির উপকূলীয় এলাকা বিদ্যমান। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সাইক্লোনের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ১৯৬০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ বার বাংলাদেশে সাইক্লোন আঘাত এনেছে। এর মধ্যে ১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৯১, ২০০৭ ও ২০০৯ সালের সাইক্লোন ছিল প্রলয়ংকরী। তবে ১৯৭০ সালের সাইক্লোনটি সর্বকালের সবচেয়ে প্রলয়ংকরী সাইক্লোন হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে। এ ঝড়ে প্রায় ৫ লক্ষ প্রাণহানি ঘটেছিল। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার প্রাণহানি ঘটেছে। ২০০৭ 19 ২০০৯ সালের সাইক্লোন সিডর (চিত্র ১.০৬) ও আইলাতে যথাক্রমে ১০ হাজার ও ৭ হাজার লোকের প্রাপহানি ঘটেছে। এছাড়া এই সাইক্লোনে লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। এ দুটি সাইক্লোনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ও ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সাইক্লোন সৃষ্টির কারণ ও করণীয়
যেহেতু সাইক্লোন সৃষ্টি হয় গভীর সমুদ্রে, তাই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সহজসাধ্য নয়। ভৰে যে দুটি কারণ মূলত সাইক্লোন সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা হলো নিম্নচাপ এবং উচ্চ তাপমাত্রা। সাধারণত সাইক্লোন তৈরি হতে সাগরের তাপমাত্রা ২৭° সেলসিয়াসের বেশি হতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত বঙ্গোপসাগরে প্রায় সারা বছরই এই তাপমাত্রা বিদ্যমান থাকে। সমুদ্রের উত্তপ্ত পানি বাষ্পীভবনের ফলে উপরে উঠে যখন জল কণায় পরিণত হয় তখন বাষ্পীভবনের সুপ্ত তাপটি বাতাসে ছেড়ে দেয়। সে কারণে বাতাস উত্তপ্ত হয় এবং বাষ্পীভবন আরো বেড়ে যায়, ফলে বায়ুমণ্ডল অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে আশপাশের বাতাস সেখানে ছুটে আসে, যা বাড়তি তাপমাত্রার কারণে ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠতে থাকে এবং সাইক্লোন সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট হওয়া ঘূর্ণিঝাড়ের বাতাসের বেগ অনেক বেশি হয়। তবে বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ৬৩ কিলোমিটার বা তার চাইতে বেশি হলে সেটাকে সাইক্লোন হিসেবে গণ্য করা হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী সাইক্লোন হয়েছিল ১৯৯১ সালে। তখন বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার।
এখন প্রশ্ন হলো, সাইক্লোনের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কি কোনো উপায় আছে? আর সাইক্লোন হলে আমাদের করণীয়ই বা কী? সাইক্লোন অত্যন্ত শক্তিশালী। একটি দুর্বল সাইক্লোনও শক্তিতে মেগাটন শক্তির কয়েক হাজার পারমাণবিক বোমার সমান। তাছাড়া যেহেতু সাইক্লোন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাই এটি প্রতিরোধ করা প্রায় অসাধ্য। সম্প্রতি আমেরিকাতে ঝড়ের সময় সিলভার আয়োডাইড (AgI) নামক রাসায়নিক দ্রব্য ৰাতাসে ছড়িয়ে পানিকে শীতল করে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ কমানোর চেষ্টা করা হলেও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি ঠিকভাবে কাজ করেনি। এছাড়া সাগরে তেল বা অন্যান্য সাইক্লোন সৃষ্টির কারণ ও করণীয় যেহেতু সাইক্লোন সৃষ্টি হয় গভীর সমুদ্রে, তাই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সহজসাধ্য নয়। ভৰে যে দুটি কারণ মূলত সাইক্লোন সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা হলো নিম্নচাপ এবং উচ্চ তাপমাত্রা। সাধারণত সাইক্লোন তৈরি হতে সাগরের তাপমাত্রা ২৭° সেলসিয়াসের বেশি হতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত বঙ্গোপসাগরে প্রায় সারা বছরই এই তাপমাত্রা বিদ্যমান থাকে। সমুদ্রের উত্তপ্ত পানি বাষ্পীভবনের ফলে উপরে উঠে যখন জল কণায় পরিণত হয় তখন বাষ্পীভবনের সুপ্ত তাপটি বাতাসে ছেড়ে দেয়। সে কারণে বাতাস উত্তপ্ত হয় এবং বাষ্পীভবন আরো বেড়ে যায়, ফলে বায়ুমণ্ডল অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে আশপাশের বাতাস সেখানে ছুটে আসে, যা বাড়তি তাপমাত্রার কারণে ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠতে থাকে এবং সাইক্লোন সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট হওয়া ঘূর্ণিঝাড়ের বাতাসের বেগ অনেক বেশি হয়। তবে বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ৬৩ কিলোমিটার বা তার চাইতে বেশি হলে সেটাকে সাইক্লোন হিসেবে গণ্য করা হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী সাইক্লোন হয়েছিল ১৯৯১ সালে। তখন বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার।
এখন প্রশ্ন হলো, সাইক্লোনের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কি কোনো উপায় আছে? আর সাইক্লোন হলে আমাদের করণীয়ই বা কী? সাইক্লোন অত্যন্ত শক্তিশালী। একটি দুর্বল সাইক্লোনও শক্তিতে মেগাটন শক্তির কয়েক হাজার পারমাণবিক বোমার সমান। তাছাড়া যেহেতু সাইক্লোন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাই এটি প্রতিরোধ করা প্রায় অসাধ্য। সম্প্রতি আমেরিকাতে ঝড়ের সময় সিলভার আয়োডাইড (AgI) নামক রাসায়নিক দ্রব্য ৰাতাসে ছড়িয়ে পানিকে শীতল করে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ কমানোর চেষ্টা করা হলেও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি ঠিকভাবে কাজ করেনি। এছাড়া সাগরে তেল বা অন্যান্য
রাসায়নিক দ্রব্য ছিটিয়ে বাষ্পীভবন কমিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তাভাবনা করা হয়। তবে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করা কখনোই বাস্তবভিত্তিক নয়। তাহলে কী করা যেতে পারে?
আমাদের ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস প্রক্রিয়া জোরদার করে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের আরেকটি মারাত্মক দিক হলো জলোচ্ছ্বাস। তাই ঘূর্ণিঝড় প্রবন এলাকায় উঁচু করে মজবুত আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় নিচু এলাকায় বসবাস করা মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর জন্য উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ তৈরি করা যেতে পারে। সাথে সাথে সেখানে প্রচুর গাছপালা লাগিয়েও ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার জন্য যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশ ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশে রেড ক্রিসেন্টের যৌথ উদ্যোগে ইতোমধ্যেই সাইক্লোন প্রস্তুতি কার্যক্রম চালু আছে। এর আওতায় প্রায় ৩২০০০ স্বেচ্ছাসেবী উপকূলীয় এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে সাইক্লোন 'মোরা' বাংলাদেশকে আঘাত করেছিল, সময়মতো যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ায় তখন মাত্র ৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল।
আমাদের অতিপরিচিত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো কালবৈশাখী। সাধারণত এপ্রিল থেকে মে মাসের ভেতর আমাদের দেশে কালবৈশাখী ঝড় হয়। সাধারণত ঈশান কোণে (North) মেঘ জমা হয়ে কিছুক্ষণের মাঝে আকাশ মেঘে ঢেকে গিয়ে কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়। এই ঝড়ে বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ৫৫ থেকে ৮০ কিলোমিটারের মতো হতে পারে। ঝড়ের বেগ ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি হলে এটাকে টর্নেডো বলা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশেই টর্নেডো আঘাত হানে। টর্নেডোর সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হচ্ছে এটি হঠাৎ করে অল্প সময়ের মধ্যে প্রচণ্ড ধ্বংসযজ্ঞ করে ফেলতে পারে।
টর্নেডো শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ শব্দ “Tonada' থেকে, যার অর্থ হলো Thunder storm বা বজ্রঝড়। সাইক্লোনের মতো টর্নেডোর বেলাতেও প্রচণ্ড বেগে বাতাস ঘূর্ণির আকারে প্রবাহিত হয় এবং এর যাত্রাপথে যা পড়ে তার সবই ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। টর্নেডোর বিস্তার মাত্র কয়েক মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৫-৩০ কিলোমিটার হতে পারে। সাইক্লোনের সাথে টর্নেডোর মূল পার্থক্য হচ্ছে যে, সাইক্লোন সৃষ্টি হয় সাগরে এবং এটি উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে আর টর্নেডো যে কোনো স্থানেই সৃষ্টি হতে পারে কিংবা আঘাত হানতে পারে। সাইক্লোনের মতো টর্নেডোর জন্যও লঘু বা নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে হয়। এর ফলে উষ্ণ বাতাস উপরে উঠে যায় এবং ঐ শূন্য জায়গা পূরণের জন্যই শীতল বাতাস ছুটে এসে টর্নেডোর সৃষ্টি হয়।বাংলাদেশে একটি প্রলয়ংকরী টর্নেডো আঘাত হানে ১৯৮৯ সালে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়াতে। ঐ আঘাতের ফলে টর্নেডোর গতিপথের মধ্যে প্রায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত শতাধিক টর্নেডো বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। স্মরণকালের ভয়াবহ টর্নেডোর মধ্যে একটি হলো ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা জেলার ডেমরা থানায়। ঐ টর্নেডোতে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৬৪৪ কিলোমিটার। যেহেতু টর্নেডোর বেলায় পূর্বাভাস কিংবা সতর্কবাণী প্রচার করা সম্ভব হয় না, তাই এক্ষেত্রে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া যায় না। তাই দুর্গত এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ এবং পুনর্বাসন কাজ করাই হচ্ছে একমাত্র সমাধান। এরকম সময় সরকারি এবং বেসরকারি সব সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করা খুবই জরুরি।
Tsunami জাপানি শব্দ। ‘সু’ অর্থ বন্দর এবং ‘নামি' অর্থ ঢেউ। সুতরাং সুনামি অর্থ হলো বন্দরের ঢেউ। এটি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সমুদ্রতলদেশে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস এবং নভোজাগতিক ঘটনা সুনামি সৃষ্টি করতে পারে। সুনামিকে পৃথিবীর তৃতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মহাসাগর এবং সাগরের তলদেশের প্লেট যখন একটির সাথে আরেকটির সংঘর্ষ হয়ে বিচ্যুত হয়, তখন সেখানে প্রচণ্ড ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। সেই ভূমিকম্পের কারণে লক্ষ লক্ষ টনের সমুদ্রের পানি বিশাল ঢেউ তৈরি করে (চিত্র ৯.০৭)। এই ঢেউ ধাবমান হয়ে যত বেশি তীরভূমির কাছাকাছি যায়, তত দীর্ঘ হয়ে ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসে রূপ নেয়। এই ঢেউয়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০০ থেকে ৮০০ মাইল পর্যন্ত হতে পারে। খোলা সমুদ্রে এই ঢেউয়ের উচ্চতা মাত্র দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত থাকে। কিন্তু ঢেউ যতই তীরের দিকে এগিয়ে যায়, ততই তার উচ্চতা বাড়তে থাকে। তখন ঢেউয়ের এক মাথা থেকে আরেক মাথার দূরত্ব ১০০ মাইল পর্যন্ত হতে পারে, অগভীর পানিতে সুনামি একটি ধ্বংসাত্মক জলোচ্ছ্বাসে রূপ নেয়। অগ্রসরমাণ জলরাশি ভয়ঙ্কর স্রোত সৃষ্টি করে নেমে যাওয়ার আগে ১০০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। একটি সুনামি উপকূলের ব্যাপক এলাকা প্লাবিত করতে পারে।
সাধারণত সমুদ্রের তলদেশে একটা ভূমিকম্প হলে সুনামি তৈরি হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে শুরু করে সমুদ্র অতিক্রম করে সুনামিকে উপকূলে পৌঁছাতে খানিকটা সময়ের প্রয়োজন। এই সময়টুকুর ভেতরে সাধারণত উপকূল এলাকায় সতর্কবাণী প্রচার করা হয়। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্মরণকালের ভয়ঙ্কর একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের কাছাকাছি ভারত মহাসাগরের তলদেশে সৃষ্টি হয়েছিল ট্রাক্টনিক ভূমিকম্প। ইউরেশিয়ান প্লেট ও অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের সংঘর্ষে সৃষ্টি হওয়া এই মারাত্মক ভূকম্পনটি ছিল রিখটার স্কেলে নয় মাত্রার। এই ভূকম্পনের ফলে ভারত মহাসাগরের একাংশ সুমাত্রার অন্য একটি অংশকে সজোরে চাপ দেয়। এই প্রবল চাপে সমুদ্রতলের ৬০০ মাইলব্যাপী এলাকায় ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এই ভাঙনের ফলে স্থানচ্যুতি ঘটে লক্ষ লক্ষ টন জলরাশির। বিশাল জলরাশি ভয়ানক বেগে সমুদ্রপৃষ্ঠের দিকে ধেয়ে আসে এবং বিশাল ঢেউয়ের আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঢেউ মহাপ্লাবনে রূপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ প্রভৃতি দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে কেনিয়া, সোমালিয়াসহ ১২টি আফ্রিকান দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। জলোচ্ছ্বাসে তিন লাখের মতো মানুষ নিহত হয়। শুধু ইন্দোনেশিয়ায় সুমাত্রার আচেহ প্রদেশেই নিহত হয়েছে এক লাখ মানুষ। তারপর বেশি লোক নিহত হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। সুনামির জলোচ্ছ্বাসে ভারত মহাসাগরের বহু ছোট ছোট দ্বীপ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব দ্বীপে বসবাসকারী বহু আদিবাসী গোষ্ঠী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে শিশু ও নারী, মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ভূতত্ত্ববিদ ও সমুদ্র বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই সুনামির তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে পৃথিবী তার অক্ষে ঘুরতে ঘুরতে কিছুটা নড়ে যায়। এছাড়া ভূকম্পনের ফলে যে বিপুল পরিমাণ শক্তির বিকিরণ হয় সেটি ছিল সাড়ে নয় হাজার পারমাণবিক বোমার সমান ক্ষমতাসম্পন্ন। সমুদ্র তলদেশে ব্যাপক ভাঙনের ফলে এতদিনকার ভারত মহাসপারের সমুদ্রপথের দিকনির্দেশনার মানচিত্রটি পর্যন্ত এলোমেলো হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নতুন করে ভারত মহাসাগরে নৌচলাচলের মানচিত্র তৈরি করতে হবে; নইলে ভবিষ্যতে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের সুনামিতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। অগভীর পানিতে যাওয়ার সময় সুনামি তার শক্তি হারায়। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত অগভীর পানি এবং এই অগভীর পানি বাংলাদেশকে সুনামির কবল থেকে রক্ষা করে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে সুনামিতে বাংলাদেশের ক্ষতি সামান্য। শুধুমাত্র কুয়াকাটার সমুদ্র উপকূলে সে সময় মাছ ধরা ট্রলার ডুবে দুজন জেলে মারা গিয়েছিল। ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গোপসাগরের আরাকান অঞ্চলে সংঘটিত একটি ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল। তখন কক্সবাজার এবং পার্শ্ববর্তী দ্বীপসমূহে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এর প্রভাবে ঢাকার বুড়িগঙ্গায় পানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার যে ঢেউরের সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে শত শত নৌকা ডুবে বহু লোক প্রাণ হারিয়েছিল।
সাধারণত বৃষ্টিপাত এমনিতেই খানিকটা এসিডিক। তবে যখন বৃষ্টিতে অনেক বেশি পরিমাণ এসিড বিদ্যমান থাকে, তখন তাকে এসিড বৃষ্টি বলে। তোমরা কি জান, এসিড বৃষ্টিতে কী কী এসিफ থাকে? এসিড বৃষ্টিতে সালফিউরিক এসিড ও নাইট্রিক এসিড বেশি থাকে এবং অল্প পরিমাণে হাইড্রোক্লোরিক এসিড থাকে। এসিড বৃষ্টি পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এসিড বৃষ্টিতে এসিডের প্রতি সংবেদনশীল অনেক গাছ মরে যায়। এছাড়া কিছু অতি প্রয়োজনীয় উপাদান (যেমন: Ca, Mg) এসিড বৃষ্টিতে দ্রবীভূত হয়ে মাটি থেকে সরে যায়, যা ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এসিড বৃষ্টি হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পানিসম্পদ এবং জলজ প্রাণীগুলোর। তোমরা জান যে, পানিতে এসিড থাকলে pH ৭-এর কম হয়। pH এর মান ৫-এর কম হলে বেশির ভাগ মাছের ডিম নষ্ট হয়ে যায়। তখন মাছ উৎপাদন ব্যাহত হয়। মাছের রেঙ্গু বা পোনা এসিডের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। এসিডের মাত্রা বেশি হলে পুরো জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মানুষের শরীরের জন্যও এসিড বৃষ্টি ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি মানবদেহে হৃৎপিন্ড ও ফুসফুসের সমস্যা, অ্যাজমা ও ব্রঙ্কাইটিসের মতো মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করতে পারে ।
এসিড বৃষ্টি কেন হয়?
এসিড বৃষ্টির জন্য প্রাকৃতিক ও মনুষ্য-সৃষ্ট দুই কারণই জড়িত। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মাঝে রয়েছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, দাবানল, বজ্রপাত, পাছপালার পচন ইত্যাদি। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাস বের হয়, যা পরে বাতাসের অক্সিজেন আর বৃষ্টির পানির সাথে বিক্রিয়া করে যথাক্রমে নাইট্রিক এসিড এবং সালফিউরিক এসিড তৈরি করে। একইভাবে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা বিশেষ করে কয়লা বা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ইটের ভাটা (চিত্র ৯.০৮), যানবাহন, গৃহস্থালির চুলা ইত্যাদি উৎস থেকেও সালফার ডাই-অক্সাইড বের হয়, যা এসিডে পরিণত হয় এবং বৃষ্টির পানির সাথে মিলে এসিড বৃষ্টি তৈরি করে। এখন দেখা যাক এসিড বৃষ্টি হলে আমাদের কী কী করণীর আছে? যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লা থেকে নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার ডাই- অক্সাইড গ্যাস তৈরি হয়, সেহেতু ব্যবহারের আগে কয়লা পরিশোধন করে সালফার নাইট্রোজেন মুক্ত করে নিতে হবে। পরিবেশ সচেতন অনেক দেশেই ইতোমধ্যেই এই ব্যবস্থা চালু আছে। পরিশোধন ব্যবস্থা না থাকলে কয়লার পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে। এসিড বৃষ্টি হলে মাটির pH কমে যায় এবং সেক্ষেত্রে লাইমস্টোন বা চুনাপাথর ব্যবহার করে এসিডিটি কমানো যায় । এছাড়া শিল্প-কারখানা এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। শিল্প-কারখানায় দূষণরোধক পদ্ধতি অবশ্যই বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে এসিড বৃষ্টি খুব একটা হয় না। যেসব দেশে শিল্প-কারখানা অনেক বেশি, সেখানে এর আশঙ্কাও অনেক বেশি। পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ, আমেরিকা, কানাডা এবং চীনের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে ও তাইওয়ানে ঘন ঘন এসিড বৃষ্টি হয়।
পৃথিবীর ভেতরে হঠাৎ সৃষ্ট কোনো কম্পন যখন ভূপৃষ্ঠে আকস্মিক আন্দোলন সৃষ্টি করে, সেটাকেই ভূমিকম্প বলে। ভূমিকম্পন কয়েক সেকেন্ড থেকে মিনিট খানেক পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং পর্যায়ক্রমে একাধিকবার ঘটতে পারে। মৃদু ভূমিকম্প আমরা অনেক সময় অনুভব করতে পারি না, কিন্তু শক্তিশালী বা প্রবল ভূমিকম্প সহজেই অনুভব করা যায়। ভূমিকম্প কি প্রাকৃতিক দুর্যোগ? হ্যাঁ, এটি অবশ্যই একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কোনো একটি দেশ বা অঞ্চল পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে (চিত্র ১.০১)। এমনকি বড় ভূমিকম্প নদীর গতিপথও পরিবর্তন করতে পারে। ভূমিকম্পের ফলে আমাদের অন্যতম প্রধান নদী ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ বদলে গিয়েছে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের ভূমিকম্প না হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পৃথিবীর মাঝে জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলে চিহ্নিত।
তোমরা নিশ্চয়ই ২০১০ সালে হাইতিতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প, ২০১১ সালে জাপানের ভূমিকম্প এবং ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের কথা শুনেছ। জাপানের ভূমিকম্পের পর সেখানে সৃষ্ট সুনামি নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রে আঘাত করে একটি নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল।এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই ভূমিকম্প হয়? আমাদের ভূগর্ভ (Earth's Crust) কতগুলো ভাগে বিভক্ত, যাদেরকে টেকটনিক প্লেট (Tectonic plate) বলে। এই টেকটনিক প্লেট কিন্তু স্থিতিশীল নয়, এগুলো চলমান। চলমান একটি প্লেট আরেকটি প্লেটে চাপ দেওয়ার কারণে সেখানে শক্তি সঞ্চিত হয়। যখন হঠাৎ করে প্লেটগুলো সরে যায়, তখন সঞ্চিত শক্তি বের হয়ে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ করা হয় রিখটার স্কেলে। রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প আমরা অনুভব করতে পারি। রিখটার স্কেলে এক মাত্রা বেড়ে যাওয়া অর্থাৎ তার শক্তি তিরিশ গুণ বেড়ে যাওয়া। একটি ভূমিকম্প যত বড় হয় তত দূর থেকে সেটি অনুভব করা যায়।
১.১০ চিত্রে বাংলাদেশ এবং তার আশপাশে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পগুলো দেখানো হয়েছে। ছবিতে নিশ্চয়ই দেখছ বাংলাদেশের ভেতরে সাম্প্রতিক কালে কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি, কিন্তু আশপাশে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পন অনুভূত হয়েছে। ১৮৮৪ সালে মানিকগঞ্জ এলাকায় রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বড় একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৯৭ সালে শিলংয়ে ৮.৭ মাত্রায় একটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। যেহেতু অতীতে এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হয়েছে, তাই আমাদের ধরে নিতে হয় ভবিষ্যতেও হতে পারে। সেটি কখন হবে যেহেতু আমাদের জানা নেই, তাই সব সময়েই প্রস্তুত থাকতে হবে।
ভূমিকম্প হলে করণীয় কী? এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় আছে কি?
ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই, তবে এতে জানমলের ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায় । সেক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিয়ম মেনে ঘর-বাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা। আমাদের দেশে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে যে সকল বড় বড় দালান-কোঠা তৈরি করা হয়, সেখানে অবশ্যই ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে তা ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে। ২০১০ সালে হাইতিতে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে তিন লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। অথচ তার থেকে ত্রিশ গুণ থেকে বেশি শক্তিশালী ৮.২ রিখটার স্কেলের একটি ভূমিকম্পে ২০১৪ সালে চিলিতে মাত্র ছয়জন মানুষ মারা গিয়েছিল। তার কারণ ভূমিকম্প প্রবণ চিলি নিয়ম করে তাদের দেশে ভূমিকম্প সহনীয় বিল্ডিং তৈরি করতে শুরু করেছে। এছাড়া ভূমিকম্প হলে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে দ্রুত ত্রাণ তৎপরতা ও উদ্ধারকাজ নিশ্চিত করতে হবে এবং তার জন্য আগাম প্রস্তুতি থাকতে হবে। বেশ কয়েকটি বিষয় সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে।
ভূমিকম্পের আগে করণীয়
১. সম্ভব হলে সব বাসাতেই অগ্নিনির্বাপক প্রস্তুতি থাকা দরকার। এর সাথে প্রাথমিক চিকিৎসা কিট, ব্যাটারি চালিত রেডিও, টর্চ লাইট কিছু বাড়তি ব্যাটারি, শুকনো খাবার এবং পানি রাখার ব্যবস্থা করা।
২. কীভাবে ফাস্ট এইড বা প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয় সেটি শিখে নাও।
৩. বাসায় গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি এবং পানির সরবরাহ কীভাবে বন্ধ করতে হয় সেটি জেনে নাও।
৪. ভূমিকম্পের পর প্রয়োজনে কোথায় কীভাবে পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলিত হতে হবে, সেটি আগে থেকে সবার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নাও।
৫. উঁচু শেলফে ভারী জিনিস রাখা যাবে না, ভূমিকম্পের সময় সেগুলো নিচে পড়ে লোকজনকে আহত করতে পারে।
৬. ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে, সেটি স্কুল কলেজ বা কর্মক্ষেত্রে “ড্রিল" করে শিখে নাও।
ভূমিকম্পের সময় করণীয়
১. ভূমিকম্পের সময় ভয়ে এবং আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হওয়া যাবে না। নিজেকে বোঝাও পৃথিবীর মানুষ ভূমিকম্পের সাথে জন্ম থেকে বসবাস করে আসছে এবং মাথা ঠাণ্ডা রাখলে বড় শক্ত টেবিলের নীচে আশ্ৰয় নাও অথবা ঘরের কোণায় চলে যাও যাতে কিছু ভেঙ্গে পড়লেও সরাসরি গায়ের ওপরে না পড়ে একটা ত্রিভূজাকৃতির জায়গা থেকে যায় তোমার ওপরবাইরে থাকলে আতংকিত না হয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। বিল্ডিং থেকে একান্ত নামতে চাইলে সিঁড়ি দিয়ে নামাই নিরাপদ উঁচু কাঠামো, বৈদ্যুতিক থাম ইত্যাদি থেকে যতদূর সম্ভব দূরে সরে যেতে হবে। ভূমিকম্পের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব।
২. তুমি যদি ঘরের ভেতরে থাকো তাহলে ভিতরেই থাকা, হুড়োহুড়ি করে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করো না। দেয়ালের পাশে দাঁড়াও। কাচের জানালা থেকে দূরে থাকো। প্রয়োজনে শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নাও। কখনোই লিফট দিয়ে নামার চেষ্টা করো না । ৩. তুমি যদি ঘরের বাইরে থাকো তাহলে বাইরেই থাকো, ঘরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করো না। ইলেকট্রিক পোল কিংবা বড় বিল্ডিং থেকে দূরে সরে যাও, উপর থেকে মাথার উপর কিছু পড়তে পারে।
৪. কোনোভাবেই ম্যাচ জ্বালিও না, গ্যাসপাইপ ভেঙে বাতাসে গ্যাসের মিশ্রণ আগুনের জন্য খুবই বিপজ্জনক।
ভূমিকম্পের পরে করণীয়
১. বড় ভূমিকম্প হয়ে থাকলে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের পরীক্ষা করে দেখো কেউ আহত হয়েছে কি না। আহত হলে প্রাথমিক চিকিৎসা দাও। গুরুতর আহত হলে হাসপাতালে নাও, মনে রেখো সত্যিকারের বড় ভূমিকম্প হলে হাসাপাতালে অসংখ্য মানুষকে জরুরি চিকিৎসা দিতে হয়। কাজেই যার প্রয়োজন বেশি তাকে আগে চিকিৎসা দেওয়া হবে।
২. পানি, ইলেকট্রিসিটি, গ্যাসলাইন পরীক্ষা করো, যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে সরবরাহ বন্ধ করে দাও। বাসায় গ্যাসের গন্ধ পেলে ঘরের দরজা-জানালা খুলে ঘরের বাইরে যাও।
৩. রেডিওতে খবর শোনার চেষ্টা কর। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে টেলিফোন ব্যবহার করে নেটওয়ার্ক অচল করে দিও না, জরুরি কাজের জন্য ত্রাণ বাহিনীকে টেলিফোন ব্যবহার করতে দাও। বড় ভূমিকম্পের পর টেলিফোন অচল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকতে পারে ।
৪. ক্ষতিগ্রস্ত বিল্ডিংয়ের বাইরে থেকো। ভাঙা কাচ ইত্যাদিতে যেন পা কেটে না যায়, সেজন্য খালি পায়ে হাঁটাহাটি করবে না।
৫. সমুদ্র উপকূলে বসবাস করলে সমুদ্র থেকে দূরে সরে যাও। সুনামি এসে আঘাত করতে পারে।
৬. ধ্বংসপ্রাপ্ত বিল্ডিংয়ের নিচে আটকা পড়লে, ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা না করে উদ্ধারকারীদের জন্য অপেক্ষা কর। নিজের শক্তি বাঁচিয়ে রাখো, উদ্ধারকারী দল এলে তাদেরকে সংকেত দেওয়ার জন্য কোনো কিছুতে নিয়মিতভাবে আঘাত করে দৃষ্টি আকর্ষণ কর।
৭. বড় ভূমিকম্প হলে আফটার শক হিসেবে আরো ভূমিকম্প হতে পারে, সে জন্য প্রস্তুত থেকো।
দলগত কাজ
কাজ: ভূমিকম্পে করণীয় কাজগুলো দিয়ে পোস্টার এবং লিফলেট তৈরি করে তোমরা এলাকায় বিতরণ কর ।
দলগত কাজ
কাজ: ভূমিকম্পের সময় করণীয় কাজের একটি ড্রিলের আয়োজন কর।
আমাদের জীবনধারণের জন্য যে আবশ্যকীয় উপাদান আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাতাস। বাতাস বা অক্সিজেন ছাড়া আমরা কতক্ষণ বাঁচতে পারি? খুব বেশি হলে দুই কিংবা তিন মিনিট। এই বাতাস যদি দূষিত হয়, অর্থাৎ এতে যদি নানা রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ (যেমন: CO, SO2, SO3, NO 2 ইত্যাদি), ধূলাবালির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা থাকে, তবে সেটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে অক্সিজেনের সাথে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং প্রাণঘাতী ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো নানা রকম রোগ সৃষ্টি করতে পারে। একইভাবে এই রাসায়নিক পদার্থ গাছপালা, মাটি এবং অন্যান্য প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাতাসের মতো পানিও আমাদের জীবনধারণের জন্য খুবই জরুরি একটি উপাদান। नम- নদীর পানি দূষিত হলে সেখানে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। বাতাস এবং পানির মতো পরিবেশের প্রতিটি উপাদানই আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। তাই এই পরিবেশ যদি মানসম্মত এবং উন্নত না হয় তাহলে এক সময় সেটি জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় রকমের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এবং এক সময় আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের নিজেদের যেমন সচেতন হতে হবে, ঠিক সেরকম আশপাশে সবাইকে সচেতন করতে হবে।
প্রকৃতি সংরক্ষণশীলতা হলো আমাদের প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা। আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ হচ্ছে বাতাস, পানি, মাটি, গাছপালা, প্রাণিজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, তেল, গ্যাস ইত্যাদি। আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রতিটি সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ। বাতাস, পানি না থাকলে বা ধ্বংস হলে আমরা যেমন বাঁচতে পারব না, তেমনি তেল, গ্যাস আর গাছপালা ছাড়াও বেঁচে থাকা অসম্ভব। আমরা যদি আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা না নিই, গাছপালা বনজ সম্পদ নিধন বন্ধ না করি, বাতাস, পানি ইত্যাদি দূষণ বন্ধ না করি, তাহলে আমাদের এই প্রকৃতি একসময় আর বাসযোগ্য থাকবে না এবং আমরা আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারব না।
প্রকৃতি সংরক্ষণশীলতার বেশ কয়েকটি কৌশল আছে। সেগুলো হলো:
১. সম্পদের ব্যবহার কমানো
আমরা পরিমিত সম্পদ ব্যবহার করে সম্পদ রক্ষা করতে পারি। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাজার থেকে কিছু কিনে আনলে একটি নতুন প্যাকেট দেওয়া হয়। আমরা যদি একটি প্যাকেটই বারবার ব্যবহার করি, তাহলে সম্পদের ব্যবহার সীমিত করা সম্ভব। আজকাল প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমরা টিস্যু, ন্যাপকিন ব্যবহার করি। একটুখানি সতর্ক হলেই এগুলোর ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। এবার তোমরা নিজেরা বের কর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোন কোন কাজে এভাবে সম্পদের ব্যবহার কমিয়ে প্রকৃতি সংরক্ষণ করতে পারি। একসময় অফিস-আদালতের সকল কাজকর্মে কাগজ ব্যবহার করতে হতো। এখন বেশির ভাগ কাজ কম্পিউটার ব্যবহার করে করা হয় বলে কাগজের ব্যবহার কমে গেছে। অনেক অফিস কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাগজের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে “কাগজবিহীন অফিস” প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কাগজ তৈরি হয় গাছপালা থেকে, কাগজের ব্যবহার কমানোর অর্থই হলো গাছপালা কম কাটতে হবে আর তাতে বনজ সম্পদ রক্ষা পাবে অর্থাৎ প্রকৃতির সংরক্ষণ হবে।
২. দূষণ থেকে সম্পদ রক্ষা
করা আমাদের প্রকৃতি বা সম্পদ দূষিত হলে সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো নদ-নদীর পানি। তোমরা অনেকে হয়তো বুড়িগঙ্গা নদীর কথা জান। দূষণের ফলে নদীর পানি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে আজ আর বুড়িগঙ্গা নদীতে মাছ তো দূরের কথা, কোনো জলজ প্রাণীই খুঁজে পাওয়া কঠিন। বুড়িগঙ্গা নদীর মতো বাংলাদেশের অনেক নদীই দূষণের শিকার হয়েছে। এসব দূষণ রোধ করা না গেলে এমন এক সময় আসবে যখন নদ-নদীতে মাছই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনিয়ন্ত্রিত কল-কারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশের অনেক শহরে বিপজ্জনকভাবে বায়ুদূষণ হয়েছে। বায়ুদূষণে পৃথিবীর প্রথম ১০০টি শহরের মাঝে বাংলাদেশের আটটি শহরের নাম রয়েছে।
৩. একই জিনিস বারবার ব্যবহার করা
সম্ভব হলে একই জিনিস বারবার ব্যবহার করে প্রকৃতি সংরক্ষণ করা যায়। আজকাল কম্পিউটারের প্রিন্টারে বা ফটোকপি মেশিনে অসংখ্য কাগজ ব্যবহার করা হয় এবং অনেক সময়েই সেখানে শুধু একটি পৃষ্ঠা ব্যবহার করা হয়। একটুখানি সচেতন হলেই কাগজের অন্য পৃষ্ঠা আমাদের নানা কাজে ব্যবহার করতে পারি। ব্যানার বিলবোর্ডে যে পলিথিন ব্যবহার করা হয়, সেগুলো অনেক উন্নত মানের, সেগুলো সংগ্রহ করে ব্যাগ তৈরি বা অন্য কাজে ব্যবহার করা যায়। প্রতিদিন আমরা অনেক প্লাস্টিকের বোতল ছুড়ে ফেলে দিই। খুব সহজেই সেগুলো পুনর্ব্যাবহার বা Recycle করা সম্ভব। আমাদের ব্যবহার্য অনেক জিনিস শিল্প-কারখানায় তৈরি হলেও তা কোনো না কোনো পর্যায়ে প্রকৃতির উপরই নির্ভরশীল। কাজেই একই জিনিস বারবার ব্যবহারে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ কমে এবং এতে প্রকৃতি সংরক্ষণ হয়।
৪. ব্যবহৃত জিনিস ফেলে না দিয়ে তা থেকে নতুন জিনিস তৈরি করা
পুরাতন জিনিস একেবারে ফেলে না দিয়ে তা থেকে নতুন জিনিস তৈরি করেও প্রকৃতি সংরক্ষণ করা যায়। আমাদের কালচারে সেটি আমরা বহু আগে থেকে করে আসছি, কাঁথা হচ্ছে তার উদাহরণ। পুরাতন কাপড় বা শাড়ি ফেলে না দিয়ে সেগুলো দিয়ে কাঁথা তৈরি করা হতো। ঠিক সেরকম পুরাতন কাগজ দিয়ে ঠোঙ্গা, পুরোনো টায়ার থেকে স্যান্ডেল কিংবা গৃহস্থালির বর্জ্য থেকে জৈব সার এ ধরনের নানা রকম জিনিসের কথা বলা যায়।
৫. প্রাকৃতিক সম্পদ পুরোপুরি রক্ষা করা
প্রকৃতি সংরক্ষণশীলতার একটি অনন্য উপায় হলো এর বিরোধিতা না করে একে রক্ষা করা বা এতে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করা। তোমরা হয়তো জান, অনেক দুষ্কৃতকারীরা সুন্দরবনে হরিণ, বাঘ এগুলো শিকার করে বা চুরি করে গাছ কাটে। শীতের পাখিকে ধরে বাজারে বিক্রয় করে, সমুদ্র উপকূলে অনিয়ন্ত্রিত অপরিকল্পিত জাহাজ ভাঙা শিল্প পড়ে তুলে সমুদ্রের পানিকে দূষিত করা। এসব কার্যক্রম বন্ধ করাই হলো প্রকৃতি সংরক্ষণ। সুন্দরবনের খুব কাছে কলকারখানা বসিয়ে বায়ুদূষণ করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে। সুন্দরবনের মতো আমাদের অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ অনেকাংশে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, যা রোধ করা অতি আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
দলগত কাজ: তোমাদের স্কুলের আশপাশে কোথায় কোথায় পরিবেশদূষণ হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন লিখো। স্কুলের মাধ্যমে সেটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাঝে পাঠিয়ে দেখো পরিবেশদূষণ বন্ধ করা যায় কি না।
দলগত কাজ: তোমার এলাকায় মানসম্মত ও উন্নত পরিবেশ সৃষ্টির অন্তরায় কী এবং সে জন্য করণীয় কী হতে পারে, সেগুলো চিহ্নিত কর। ৪-৫ জন বন্ধু বা সহপাঠী মিলে একটি গ্রুপ তৈরি কর। নিজ নিজ এলাকায় পরিবেশগত সমস্যা চিহ্নিত কর। এক্ষেত্রে পানিদূষণ, যত্রতত্র ময়লা ফেলা, খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ ইত্যাদি বিবেচনায় রাখ। এসব দূষণের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে পোস্টার বা লিফলেট তৈরি করে সবার মাঝে বিলি কর। পত্রপত্রিকায় চিঠি লিখো, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহযোগিতা কাজে লাগাও। প্রয়োজনবোধে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, পরিবেশবাদী সংগঠন, বেসরকারি সংস্থার সাহায্য নাও ।
আরও দেখুন...